বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার করেছেন সাবেক রেলপথ মন্ত্রী ও রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম। ছেলে মিতুল হাকিমের নেতৃত্বে এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের বিপক্ষে কেউ কথা বললে চরম মূল্য দিতে হতো। লুট করেছেন কোটি কোটি টাকা। রেহাই পাননি জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক এমনকি নিজ দলের নেতাকর্মীরাও।
স্থানীয়দের অভিযোগ, টানা ১৬ বছর জিল্লুল হাকিমের দাপট দেখেছেন পাংশা, কালুখালী ও বালিয়াকান্দির মানুষ। বাপ-বেটার সন্ত্রাসী বাহিনীর নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকে। খুনের অভিযোগও কম নয়। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে তাদের সেই ত্রাসের রাজত্বের অবসান হয়েছে।
এতদিন ভয়ে মুখ না খুললেও এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকে জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নৌকার টিকিটে ৫ বার সংসদ সদস্য হন জিল্লুল হাকিম। এক সময় মাত্র ৫০ হাজার টাকার জন্য মনোনয়ন কিনতে পারছিলেন না। অথচ অবৈধ উপায়ে এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক! ক্ষমতার অপব্যবহার করে জেলা পরিষদের জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন আলিশান মার্কেট।
আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে এতো দূর এলেও দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরাও রেহায় পাননি তার নির্যাতন থেকে। অভিযোগ আছে, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভোট কারচুপির মাধ্যমে নিজেদের আশীর্বাদপুষ্টকে জিতিয়ে নিতেন জিল্লুল ও তার ছেলে। তাদের বিপক্ষে কথা বললেই চরম মূল্য দিতে হতো। নিজ দলের শত শত নেতাকর্মীকে এলাকাছাড়া করে রেখেছিলেন তারা। বাবা-ছেলের পালিয়ে যাওয়ার পর এখন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন রাজবাড়ী-২ আসনের বাসিন্দারা। তাদের নির্যাতনে এলাকা ছাড়া মানুষ ৫ আগস্টের পর থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার বিভিন্ন পদে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে সাব রেজিস্ট্রি অফিস ও বিভিন্ন অফিস থেকে ১৫ শতাংশ করে কমিশন নিতেন জিল্লুল হাকিম। অবৈধ নিয়োগে সহায়তা না করায় ১১ বছর এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে কর্মস্থলে ঢুকতে দেননি তিনি। তার বেতন-ভাতাও বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।
রাজবাড়ী জেলা কৃষক লীগের সভাপতি ও পাংশা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী নাদের হোসেন। রাজনীতি করতেন জিল্লুল হাকিমের সঙ্গেই। তবে প্রতিবাদ করতেন জিল্লুলের সমস্ত অন্যায়ের। ফলে ক্ষমতাধর জিল্লুলের বাঁকা নজরে পড়েন কৃষক লীগের এ নেতা। ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে তাকে। মামলা করেও কোনো বিচার পায়নি পরিবার।
পরিবারের দাবি, জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলে মিতুল হাকিমের নির্দেশেই সন্ত্রাসীরা মুন্সী নাদের হোসেনকে হত্যা করে।
নাদের হোসেনের ছেলে মোস্তফা মাহমুদ হেনা মুন্সী বলন, ‘আমার বাবা এলাকায় খুবই জনপ্রিয় একজন রাজনীতিবীদ ছিলেন। জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলের অন্যায়-অপকর্মের প্রতিবাদ করার কারণে তারা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমার বাবাকে হত্যা করেছে। বাবা হত্যার বিচার চাওয়ায় তারা আমাকে একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। জিল্লুল হাকিম তার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বিচার কাজে বাধা সৃষ্টি করেছে। ফলে এখন পর্যন্ত আমি বাবা হত্যার বিচার পাইনি।’
জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলের সন্ত্রাসী বাহিনীর অপকর্ম নিয়ে ২০১৭ সালে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন পাংশা প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ। এজন্য চরম মূল্য দিতে হয় তাকে। লোহার রড ও হাতুড়ি দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে কয়েক টুকরো করা হয় তার হাত-পা। মামলা করলেও পরে তা তুলে নিতে হয় তাকে।
সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে আমার ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালানো হয়। এ হামলার নির্দেশদাতা জিল্লুল ও তার ছেলে মিতুল। আমি এ হামলার বিচার চাই। আর এ ঘটনার কারণেই আমার বাবা মারা গেছেন। এ কারণে আমার পরিবার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো তাদের ভয়ে রয়েছে আমার পরিবার, কারণ তাদের অসংখ্য ক্যাডার বাহিনী আছে।’
জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলের নির্দেশ অমান্য করে ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর পাংশা উপজেলা পরিষদে একটি রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের টেন্ডার শিডিউল কিনতে যান তাদেরই দলের কর্মী হৃদয় মীর। এ অপরাধে হাতুড়ি দিয়ে পিয়ে এবং পায়ের রগ কেটে দেয় সন্ত্রাসীরা। আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় এই যুবককে।
হৃদয় মীর বলেন, ‘মিতুল হাকিমের পালিত সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমার বাম পায়ের গোড়ালির ওপরের রগ কেটে ফেলে। আমি চিৎকার করলে তারা আমার মুখের ভেতরে আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকিয়ে আমার দুইটি দাঁত ভেঙে ফেলে। পরে হাতুড়ি দিয়ে আমাকে মারপিট করে এবং ধারালো চাপাতি দিয়ে আমার মাথাসহ বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে জখম করে ফেলে রেখে চলে যায়।’
পাংশা বয়রাট মাজাইল ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মাদ্রাসার সহকারী একটি শূন্য পদে জিল্লুল হাকিম অবৈধভাবে নিয়োগ দিতে চায়। আমি সেই কাগজে স্বাক্ষর না করার কারণে জিল্লুল হাকিমের সন্ত্রাসী বাহিনী আমাকে অফিসে আটকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর ধরে আমাকে মাদ্রাসায় ঢুকতে দেয়নি। প্রভাব খাটিয়ে এই দীর্ঘ সময় ধরে আমার বেতন-ভাতাও বন্ধ করে রেখেছে। আমি তার কাছে বছরের পর বছর ঘুরেছি। এটা নিয়ে কোনো সমাধান করেনি। বরং যখনই তার কাছে গিয়েছি তখনি তার সন্ত্রাসী বাহিনী ও তার ছেলের ক্যাডার বাহিনী আমার ওপর অত্যাচার চালিয়েছে।’
পাংশা বাগদুলী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক এস এম আতাউল্লাহ শামীম রহমান বলেন, ‘২০১৮ সালের ৬ আগস্ট রাতে জিল্লুল এবং তার ছেলের মোটরসাইকেল বাহিনী এসে আমাকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। আমার অবস্থা খুবই গুরুতর ছিল। একমাত্র আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছে। এখন সময় এসেছে তাই এ সন্ত্রাসী বাবা ও ছেলের বিরুদ্ধে আমি মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছি।’
জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলে মিতুল হাকিম তাদের ক্যাডার বাহিনীকে গোপন অস্ত্র দিয়েছিল বলেও দাবি করেন এ শিক্ষক।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে জিল্লুল হাকিমের পাংশা পৌর শহরের বাড়িতে গেলে বাড়ির গেট তালাবদ্ধ দেখা যায়। জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলে মিতুল হাকিমের ফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক এই রেলমন্ত্রী, তার ছেলে মিতুল হাকিমসহ তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজবাড়ীর আদালতে তিনটি ও বালিয়াকান্দি থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় অপহরণ, নির্যাতন, হত্যাচেষ্টা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ মেলেনি জিল্লুল ও মিতুলের। গাঢাকা দিয়েছে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীও।